বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : শনিবার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মদিন। তার আগের দিন কেন্দ্র ও রাজ্যের তৎপরতা যখন তুঙ্গে পশ্চিমবাংলায়, রাজনীতিতে একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল ঠিক সেই সময়ই। রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিলেন বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও তা গৃহীত হওয়ার আগেই তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। শুধু তাই নয়, ক্রমাগত দলবিরোধী মন্তব্য করে যাওয়ায় বালির বিধায়ক বৈশালি ডালমিয়াকেও বহিষ্কার করা হয়েছে তৃণমূল থেকে। রাজনীতির বাইরে ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বৈশালি। শুভেন্দু অধিকারীর পর মন্ত্রিসভা থেকে রাজীবের ইস্তফার ঘটনায় রাজ্য রাজনীতিতে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছে।
শুক্রবার সকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়ে ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে চিঠি দিয়ে আসেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রীর তরফে কোনও রকম প্রতিক্রিয়াই দেওয়া হয়নি। ফলে পরে তিনি সরাসরি রাজভবনে চলে যান। সেখানে গিয়ে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তিনি ইস্তফাপত্র দেন। তার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন। বলেন, ‘আমি কখনও ভাবিনি আমার জীবনে এই রকম একটি দিন আসবে। আজ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ এখানেই থেমে যাননি তিনি। বলেন, ‘আমি সেচমন্ত্রী ছিলাম। কিন্তু আড়াই বছর আগে কোনও কারণ ছাড়াই আচমকা আমাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নিজের ক্ষমতাবলে মুখ্যমন্ত্রী সেই কাজ করতেই পারেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সতীর্থের প্রতি কোনও রকম সৌজন্যই দেখাননি।’
বিষয়টির ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমি তখন মন্ত্রিত্বের কাজেই উত্তরবঙ্গে ছিলাম। হাওড়ার ডোমজুড়ে ফিরে দলের কর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম। সেখানেই হঠাৎ টিভি চ্যানেলের খবরে দেখলাম আমাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই খবর আমাকে টিভি দেখে জানতে হল! দলের কর্মীদের সামনে সেদিন রীতিমতো অপ্রস্তুত হতে হয়েছিল আমাকে।’ এদিকে, নবান্ন সূত্রে খবর, ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’র কথা উল্লেখ করে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্তফাপত্র গ্রহণ করেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবর্তে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই বার্তায় বলা হয়েছে, রাজ্যের মন্ত্রিসভা থেকে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে অপসারিত করা হোক। যদিও সরকারের এই আচরণে তৃণমূলের একাংশ চূড়ান্ত ঔদ্ধত্যই দেখছে। এমনিতে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজনীতিতে সকলে একজন ভদ্রলোক হিসেবেই জানেন। তাই তাঁর প্রতি এমন আচরণ অনেকেই নাকি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। যদিও প্রকাশ্যে তাঁরা কেউই বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি।
রাজীবের ইস্তফার পর মুখ খোলেন বৈশালি। বলেন, ‘রাজীবের পদত্যাগে দলের বড় ক্ষতি হবে। শুধু দল নয়, সাধারণ মানুষেরও ক্ষতি এটা। কারণ, তিনি সত্যিই কাজের মানুষ। এমন একজন দায়িত্ববান মন্ত্রীর ইস্তফায় আমরা দুশ্চিন্তা ও দুঃখ হচ্ছে।’ কিন্তু, এর আধ ঘণ্টা পর আরও একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে। বালির বিধায়ক বৈশালি ডালমিয়াকে দল থেকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করা হয়। ক্রমাগত দলবিরোধী মন্তব্য করে যাওয়ায় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রে খবর। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তিনি বিভিন্ন দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হতে শুরু করেন। তাঁকে না জানিয়েই দল বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছে বলে প্রকাশ্যেই তিনি অভিযোগ করেছিলেন। লক্ষ্মীরতন শুক্লা রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরও তিনি বলেছিলেন, কেউ কেউ উইপোকার মতো দলকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
সমালোচনাগুলি যে দল ভালো ভাবে গ্রহণ করছিল না, তা এদিনের সিদ্ধান্ত থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়। ঘটনার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বৈশালি বলেন, ‘মানুষকে আগলে রাখা যদি দলবিরোধী হয়, তা হলে আমি দলবিরোধী। আসলে দলে এখন উইপোকারাই বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।’ অন্যদিকে, ৩১ জানুয়ারি হাওড়ায় অমিত শাহের জনসভা রয়েছে। সূত্রের খবর, সেই সভায় রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, বৈশালি ডালমিয়া ছাড়াও উত্তরপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক প্রবীর ঘোষাল, হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র তথা তৃণমূল নেতা রথীন চক্রবর্তী বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন। এদিকে, রাজীব প্রসঙ্গে তৃণমূলের তরফে মুখ খোলেন সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘অন্য দলে গেলে রাজীব যেন ডোমজুড়েই দাঁড়ায়। বুঝিয়ে দেব।’ দলের আরেক বিক্ষুদ্ধ সাংসদ অপরূপা পোদ্দার অবশ্য মমতার পরামর্শ মেনে দলেই থেকে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাজীবদা নেত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন।’
রাজ্যের মন্ত্রিসভা থেকে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্তফার পর কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিজেপিও। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘রাজ্যে এখন সার্কাস চলছে। আগে আমরা শীতকালে সার্কাস দেখতাম। এখন দিদিমণির সার্কাস দেখছি।’ সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘বোঝাই যাচ্ছে তৃণমূল এখন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে। যাঁরা কাজের মানুষ, ভালো মানুষ, তাঁদের আমরা আমাদের দলে স্বাগত জানাচ্ছি। রাজীবদাও যদি বিজেপিতে আসেন, তাঁকে আমরা স্বাগত জানাব।’